আবার ভূত!!!!!!! - omar360. বাংলাদেশের সকল শিক্ষণীয় বিষয় এর সমাহার

Header Ads

আবার ভূত!!!!!!!



অনেক অলৌকিক কান্ড পৃথিবীতে ঘটে, যার বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়।
এ'রকম দু একটি ঘটনা নিশ্চয় তোমাদেরও শোনা।
স্বামী -স্ত্রী ফটো তুলেছে, সেই ফটোতে স্বামী আর স্ত্রী'র মাঝখানে অন্য একটি মেয়ের মুখ। মুখটি অবশ্য খুব পরিষ্কার নয়, কিন্তু বেশ বোঝা যায়।
দোকান থেকে ফটোটা যখন বাড়িতে দিয়ে গেল, তখন স্বামী অফিসে। স্ত্রী ফটো দেখেই চমকে উঠল।
একি, ফটো তোলবার সময় স্টুডিয়োতে তো খালি তারা দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল। এ মেয়েটির মুখ এল কোথা থেকে?
ফটো প্রিন্ট করার সময় নিশ্চয়ই অন্য ফটোর সাথে জুড়ে গেছে!
স্ত্রী রীতিমতো চিন্তিত হয়ে উঠল।
স্বামী অফিস থেকে ফিরতেই স্ত্রী ফটোটা নিয়ে তার কাছে ছুটে গেল। রেগে বলল, " একেবারে বাজে স্টুডিয়ো, দেখ আমাদের ফটোটা কিভাবে নষ্ট করে দিয়েছে! "
ফটোটা দেখেই স্বামী চমকে উঠল।
একি, আশ্চর্য কান্ড।
তাদের দুজনের মাঝখানে যে মুখটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, সেই মেয়েটির মুখ তার খুব চেনা। কিন্তু তার পরিচয় সে স্ত্রী'র কাছে দেবে কি করে?
মেয়েটি আসলে ছিল তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী। বিয়ের ছ'মাস পর সে মারা গিয়েছিল।
তার কোনও ফটো তোলা হয়নি। অথচ এ ফটোতে তার মুখ এল কি করে!!
স্বামী যে এর আগে একবার বিয়ে করেছিল, সে কথা স্ত্রী জানে না। তাকে বলা হয়নি।
ফটোটা নিয়ে স্বামী বলল, " আমি এখনই স্টুডিয়োতে যাচ্ছি। এভাবে ফটো নষ্ট করার জন্য খুব কড়া কথা শুনিয়ে দেব"।
স্টুডিয়োর মালিককে স্বামী সব বলতে, সে বলল, " আর বলবেন না মশাই। আমরা কিছু ভেবেও কুলকিনারা পাচ্ছি না। যতবার ওয়াশ করি, ওই একই ব্যাপার, মেয়েটির মুখ ফুটে ওঠে। আপনি মেয়েটিকে চেনেন নাকি?"
" না, না, আমি চিনব কি করে। এ ফটো আপনারাই রেখে দিন, আমার দরকার নেই"।
ঝামেলা এড়াতে স্বামী ফটোটা স্টুডিয়োতেই রেখে এসেছিল। কিন্তু তাতে বিপদ কাটেনি।
মাঝরাতে স্ত্রী চিৎকার করে বিছানার ওপর উঠে বসেছে।
" কি হলো? কি হলো?" বলে স্বামীও ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে।
" সেই মুখটা আমায় কিসব বলছে! " আতঙ্কিত গলায় বলল স্ত্রী।
..........." কোন মুখটা?"
........" যে মুখ আমাদের ফটোতে দেখা গিয়েছিল। চোখ দুটো লাল করে খোনা খোনা গলায় আমাকে শাসিয়ে বলছে, 'এ আমার বাড়ি, আমার স্বামী। তুই যা, যা এখান থেকে। নইলে তোর গলা টিপে ধরব"।
স্বামী স্তোকবাক্য দিয়ে স্বান্তনা দেবার চেষ্টা করছে স্ত্রী কে। বলছে, " তুমি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছ। তোমার কোনও ভয় নেই। স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছ"।
স্বামী ব্যাপারটা চেপে গেলেও, পাড়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকে স্ত্রী আসল ব্যাপারটা জানতে পারল।
তারাই বলে ফেলল, বারণ স্বত্তেও, যে স্বামীটি আগে একবার বিয়ে করেছিল। প্রথম স্ত্রী কুয়োতলায় জল তুলতে গিয়ে পা পিছলে সিমেন্টের ওপর পড়ে মাথায় চোট পায়। দু'দিন পরেই মারা যায়।
- এই হলো কাহিনীটা। এর পরের কাহিনী আমার জানা নেই। সম্ভবত এটা আমি ' পরলোকের কথা' বইটায় পড়েছিলাম।
যাক, এ তো গেল বইয়ের কাহিনী। এখন নিজের কথা বলি।
ভূত সন্মন্ধে আমার কৌতূহল ছেলেবেলা থেকেই। বড় হয়ে দেশী-বিদেশী প্রেততত্ত্বের ওপর যে কত বই যোগাড় করে পড়েছি, তার ঠিক নেই। ঈশ্বরকে বিশ্বাস করার ব্যাপারে যেমন মোটামুটি তিনটে দল আছে - আস্তিক, নাস্তিক আর সন্দেহবাদী। ভূতের ব্যাপারেও ঠিক তাই। আমি এই সন্দেহবাদীদের দলে।
ভূত থাকতেও পারে, আবার না থাকলেও আশ্চর্য হব না।
কিন্তু গত নভেম্বর মাসে একটা ঘটনার পর নিজের মত বদলাতে বাধ্য হয়েছি।
সভা সমিতির ব্যাপারে আমি চিরকালই ভয় পাই। বিশেষ কোথাও যাই না, সবিনয়ে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করি।
কিন্তু সেবার জামশেদপুরের এক সাহিত্য সম্মেলনে আমায় যেতে হয়েছিল, কারণ আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেই সম্মেলনের উদ্যোক্তা।
আমার সঙ্গে আরও যে তিনজন সাহিত্যিক গিয়েছিলেন, তাঁরা আশেপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্য রয়ে গিয়েছিলেন। সভার অধিবেশন শেষ হতেই আমি বেরিয়ে পড়লাম।
তার অবশ্য কারণ ছিল।
আমার ঘাটশিলার অন্তরঙ্গ বন্ধু মুকুল চক্রবর্তী বিশেষ করে আমায় চিঠিতে লিখেছিল, ফেরার পথে আমি যেন ঘাটশিলায় তার কাছে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাই।
বিভূতিভূষণের স্পর্শে ঘাটশিলা সাহিত্যিকদের কাছে তীর্থস্বরূপ।
কিন্তু মানুষ গড়ে আর ঈশ্বর ভাঙেন।
ট্রেন গলৌডির কাছে গিয়ে আটকে গেল।
একদল লোক লাইনের ওপর বসে পথ অবরোধ করে আছে। ট্রেন তারা একচুল নড়তে দেবে না, যতক্ষণ না তাদের আবেদন মঞ্জুর না হয়।
কি তাদের আবেদন?
এতদিন বম্বে এক্সপ্রেস গলৌডিতে থামত। হঠাৎ নতুন সময়পঞ্জিতে নিয়ম হয়েছে, সে আর গলৌডিতে থামবে না। হাওয়ার বেগে স্টেশন অতিক্রম করে যাবে।
এতে গলৌডিবাসীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
ট্রেনের ড্রাইভার আর গার্ড বিক্ষোভকারীদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অনুরোধ করে বলল, " ট্রেনটা আজকের মতো চলতে দিন। কারণ আজ রবিবার। চক্রধরপুরে খবর দিয়েও কোনও লাভ হবে না। ছুটির দিন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষরা কেউ অফিসে আসেন না। অথচ তাঁরা ছাড়া আমাদের পক্ষে এ বিষয়ে কিছু বলা সম্ভবও নয়।"
বিক্ষোভকারীরা চুপচাপ। এসব আবেদন তাদের কানে গেছে বলে মনে হলো না।
দু ঘন্টা পার হয়ে গেল। চারদিকে অন্ধকার। কয়েকটা জোনাকি উড়ছে।
কামরা থেকে নেমে পড়লাম।
একজন মাতব্বরকে জিজ্ঞাসা করলাম, " কি ভাই, ট্রেন কখন ছাড়বে?"
আমার দিকে অবহেলাভরে একবার দেখে নিয়ে লোকটা বলল, "আমাদের দাবি মানলেই ছাড়বে। আজ ছুটির দিন, কর্তারা বুঝি কেউ নেই, কাজেই আগামীকাল বেলা দশটার আগে তো ছাড়ছেই না"।
সরে এলাম। কামরার মধ্যে চুপচাপ বসে থাকতে ভাল লাগল না। তাছাড়া, এক মারোয়াড়ী দম্পতি আর তাদের দুই নাবালক শিশুপুত্র নিয়ে আমার সহযাত্রী। ইতিমধ্যে তাদের সঙ্গে যে খাবার, ফলমূল ছিল, তা খেয়ে শেষ করেছে বাচ্চাদুটো। কিন্তু তাতেও তাদের ক্ষুধা মেটেনি, দুজনে তারস্বরে চিৎকার করছে। কামরার মেঝে ফলের খোসা, জল আর শালপাতায় নরককুন্ডের রূপ নিয়েছে।
ট্রেন থেকে নেমে রেললাইন ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। এমনিই খোলা হাওয়ায় একটু হাঁটার উদ্দেশ্যে।
মেঘে-চাঁদে লুকোচুরি খেলা চলছে। ফলে কখনো আলো, কখনো অন্ধকার। চারধারে আকন্দ, বনতুলসী আর ছোট ছোট কাঁটাগাছের ঝোপ।
বেশ কিছুটা এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
চারদিকে ধূ ধূ মাঠ। এলোমেলো হাওয়া বইছে। ম্লান জ্যোৎস্নার আলো।
স্পষ্ট দেখলাম, মাঠের ওপর একটি মেয়ে শুয়ে। দুটো হাত বুকের ওপর জড়ো করা, মাথার বেণী ছড়িয়ে পড়েছে।
এমন জায়গায় মেয়েটি এল কি করে? শাড়ি পরার ধরনে তো বাঙালি মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। বয়স চোদ্দ-পনেরো'র বেশী নয়।
খানিক এগিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
মেয়েটিকে কেউ এখানে মেরে ফেলে রেখে যায়নি তো? তাই হওয়া সম্ভব, নইলে মেয়েটি এমন ফাঁকা জায়গায় নিস্পন্দ হয়ে পড়ে থাকত না!
চিন্তাটা মনে আসতেই পিছিয়ে গেলাম।
মেয়েটির কাছে গিয়ে বিপদ ডেকে আনব নাকি? হঠাৎ যদি পুলিশের লোক দেখে ফেলে? কি বলব তাদের?
ট্রেন আটকেছে, তাই ফাঁকা মাঠে একটু পায়চারী করছিলাম - এমন একটা কথা নিজের কানেই কেমন অসংলগ্ন ঠেকল।
তারপর আমি যে নির্দোষ তা হয়তো প্রমাণ করতে পারব। কিন্তু বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে চুয়ান্ন। মনোকষ্ট, অর্থনাশ, স্রেফ ঝামেলা।
কয়েক পা এগিয়ে কৌতূহলের বশে ফের তাকালাম।
কোথাও কেউ নেই। তাহলে কি চোখের ভুলে মেয়েটিকে দেখলাম? অনেক সময় ফিকে চাঁদের আলো বিভ্রমের সৃষ্টি করে।
কিন্তু এত কাছ থেকে ভুল দেখলাম!
এদিক ওদিক তাকিয়েই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
দেখলাম, একটু দূরেই সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। শুধু দাঁড়িয়ে থাকাই নয়, আমার দিকে চেয়ে ফিকফিক করে হাসছে।
তবে কি মেয়েটি এই ট্রেনেরই যাত্রী? ট্রেন চলছে না দেখে আমারই মতো নেমে এদিকওদিক হাঁটছিল। তারপর ক্লান্ত হয়ে মাঠের ওপর শুয়ে পড়েছিল কি ঘুমিয়েই পড়েছিল.....! আমি দেখে মৃত মনে করেছিলাম।
মেয়েটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, " এখানে কি করছ?"
মেয়েটি হেসেই বলল, " আপনারই মতো বেড়াচ্ছি"।
......." কেন, ট্রেনে ভাল লাগে না?"
....." বিচ্ছিরি। লোকের ভীড়ে দম আটকে আসার যোগাড় হয়। এ জায়গাটা আমার খুব চেনা। চলুন। আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই"।
বুঝলাম, মেয়েটি কাছাকাছিই কোথাও থাকে। সম্ভবত গিডনীতে। স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য অনেকেই গিডনীতে আসে।
বললাম, " চলো। কিন্তু ট্রেন আবার ছেড়ে দেবে না তো?"
......" দিক না। ট্রেনের চেয়েও আগে আমি ছুটতে পারি"।
কথাটা সত্যি। কারণ, কোনও মেয়ে যে এত দ্রুত হাঁটতে পারে, আমার কল্পনাতেও ছিল না। আমি লম্বা লম্বা পা ফেলেও তার নাগাল পাচ্ছিলাম না। সে আমার চেয়ে অন্তত চার পাঁচ গজ এগিয়েই রইল।
" তুমি থাকো কোথায়? " চলতে চলতেই জিজ্ঞেস করলাম।
আমার প্রশ্ন শুনে মেয়েটি ফিক করে হাসল। বলল, " ওই তো রেললাইনের ধারে।"
বুঝতে পারলাম মেয়েটি পরিহাস করছে। আসল ঠিকানা আমায় বলতে চায় না।
হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল আমার। উঁচুনিচু জমি। মাঝেমাঝে পাথরে হোঁচট খাচ্ছিলাম, কিন্তু আশ্চর্য, একটানে মেয়েটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছিলাম।
মেয়েটি বোধহয় আমার অবস্থা বুঝতে পারছিল।
আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, " আপনারা কলকাতা শহরের লোক কিনা, তাই একদম হাঁটতে পারেন না। একটু পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে পড়েন। নিন, আমার হাতটা ধরুন"।
মেয়েটি আমার হাত ধরল।
ঠিক মনে হলো আমার হাতে যেন বরফের স্পর্শ লাগল। আমার সব রক্ত জমে হিম হয়ে গেল। সারা শরীর অবশ।
" তোমার হাত এত ঠাণ্ডা কেন?" জিজ্ঞেস করলাম।
মেয়েটি আবার ফিক করে হাসল। বলল, " সব সময়েই বাইরে বাইরে ঘুরি কিনা। তাছাড়া শরীরে রক্তই যে নেই"।
মেয়েটি প্রায় টানতে টানতে আমায় নিয়ে চলল।
চাঁদের ফালি মেঘে ঢাকা পড়ে গেল। সব অন্ধকার।
অনেক কষ্টে মেয়েটির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মাটির ওপর বসে পড়লাম।
"আর চলতে পারছি না"।
........" চলতে তোমাকে হবেই"।
মেয়েটির গম্ভীর কন্ঠস্বরে মুখ তুলেই চমকে উঠলাম।
কোথায় মেয়েটি! তার জায়গায় একটা নরকঙ্কাল!!! শুধু দুটো চোখ দিয়ে যেন আগুনের হলকা বেরোচ্ছে। বাতাস লেগে দাঁতগুলো কড়মড় করে উঠছে।
আমি খুব ভীরু প্রকৃতির নই। বন্ধুমহলে সাহসী বলে নাম আছে। কিন্তু চোখের সামনে মেয়েটিকে এভাবে নরকঙ্কালে পরিণত হতে দেখে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে যেন হিমের স্রোত নেমে গেল।
এত কাছ থেকে এইরকম চোখের ভুল কখনো হতে পারে!!
" ওঠো, চলে এসো ", কঙ্কাল বলল।
কন্ঠস্বরও আগের মতো স্বাভাবিক নয়। অন্তত মেয়েটির গলার সঙ্গে কোনও মিল নেই।
বহুকষ্টে উঠে দাঁড়ালাম। দুটো পা-ই ঠকঠক করে কাঁপছে। একবার ভাবলাম, তীরবেগে পেছন দিকে দৌড়োই, কিন্তু বুঝতে পারলাম, তাতেও মেয়েটির কাছ থেকে নিস্তার পাব না।
দুটি হাত দিয়ে হয়তো আমার কণ্ঠনালী চেপে ধরবে। আমার প্রাণহীন দেহ এই তেপান্তরের মাঠে পড়ে থাকবে।
বাধ্য হয়ে মেয়েটিকে অনুসরণ করলাম। মেয়েটি নয়, একটা কঙ্কাল।
প্রতি পদক্ষেপে হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি হয়ে শব্দ হচ্ছে - ঠক, ঠক, ঠক।
আমার চারপাশ ঘিরে ঠাণ্ডা বাতাসের আমেজ। মনে হচ্ছে যেন আশেপাশে প্রবল বৃষ্টি হয়ে গেছে।
নিজের শক্তিতে নয়, কঙ্কালের আকর্ষণে ছুটে চলেছি।
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, এগোবার সঙ্গে সঙ্গে কঙ্কালটা লম্বায় বাড়ছে।
ছ'ফুট, সাত ফুট, আট ফুট। উঁচু উঁচু গাছগুলো ছাড়িয়ে কঙ্কালের মাথা দেখা যাচ্ছে। পাঁজরের মধ্য দিয়ে সোঁ সোঁ শব্দে বাতাস বইছে।
ভয়ে চলবার শক্তি হারালাম। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লাম।
কঙ্কাল কয়েক পা গিয়েই ফিরে দাঁড়াল। দু চোখে আগুনের হলকা। আমার অবস্থা দেখে হা হা করে পৈশাচিক হাসি হেসে আমার দিকে দীর্ঘ মাংসহীন হাত বাড়িয়ে দিল।
চিৎকার করে জ্ঞান হারালাম।
কতক্ষণ অচেতন ছিলাম, জানি না। যখন জ্ঞান হলো, দেখি অন্ধকার আর নেই, প্রায় ভোর হয়ে এসেছে।
উঠে বসলাম। চারদিকে মাটির হাঁড়ি, বাঁশের টুকরো, মড়ার মাথার খুলি এবং হাড়গোড় ছড়ানো। বোঝা গেল, জায়গাটা শ্মশান।
সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম।
অনেক দূরে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে দুজন লোক যাচ্ছিল, হাততালি দিয়ে তাদের কাছে ডাকলাম।
কাছে আসতে জিজ্ঞেস করলাম, " গলৌডি স্টেশন এখান থেকে কতদূর? "
তাদের একজন বলল, " তা মাইল সাতেক হবে"।
সাত মাইল! গত রাতে এই সাত মাইল পথ কি করে হেঁটে এলাম, তা ভেবেই আশ্চর্য লাগল।
এতটা পথ ফিরব, অথচ দেহে আমার সে শক্তি নেই। কিন্তু ফিরে আমায় যেতেই হবে।
ধীরেধীরে এগোতে শুরু করলাম। মনকে বোঝালাম, গত রাতে যা দেখেছি সবই আমার মনের কল্পনা। জ্যোৎস্না রাতে ফাঁকা মাঠে কোনও কারণে ভয় পেয়েছিলাম আর সেই ভয় থেকেই মনগড়া মেয়েটির মূর্তি জন্ম নিয়েছে।
গলৌডি স্টেশনে যখন এসে পৌঁছলাম তখন আর দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি আমার দেহে ছিল না।
বোধহয় কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম, জ্ঞান ফিরে চোখ মেলতে দেখি, আমার চারপাশে একটা ভিড়।
" যান, যান, ভিড় করবেন না এখানে", বলতে বলতে স্টেশনমাস্টার এগিয়ে এসে ভিড় সরিয়ে আমায় তাঁর ঘরে নিয়ে গেলেন। পোর্টারকে বলে এক গ্লাস গরম দুধের ব্যবস্থা করলাম। দুধ খেয়ে অনেকটা চাঙ্গা হলাম।
স্টেশনমাস্টারকে জিজ্ঞেস করলাম, " ট্রেন কি ছেড়ে দিয়েছে? "
" না, স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে", বললেন স্টেশনমাস্টার, "চক্রধরপুর থেকে ট্রলি করে কর্তারা আসছেন। তাঁরা কথা দিলে তবে ট্রেন ছাড়বে। তা, আপনি কে? এইরকম অসুস্থ হয়ে পড়লেন কিভাবে?"
পুরো ঘটনাটা তখন খুলে বললাম স্টেশনমাস্টারকে।
সব শুনে তিনি শিউরে উঠলেন, " সর্বনাশ! আবার সেই রেবা সোমের ব্যাপার!"
...... " রেবা সোম! সে কে?"
" বছর দুই আগের ঘটনা", স্টেশনমাস্টার বলতে লাগলেন, " এই বম্বে এক্সপ্রেসেই ঘটেছিল ঘটনাটা। বোরখা পরে মহিলা-যাত্রীর ছদ্মবেশে কয়েকজন ডাকাত লেডিস-কামরায় উঠে পড়েছিল। মাঝরাতে হঠাৎ তারা বোরখা খুলে তাদের সামনে ছুরি-পিস্তল বের করল।"
......." সর্বনাশ! তারপর? "
"অন্য মহিলা যাত্রীরা ভয়ে যে যার টাকাকড়ি, গয়নাগাটি খুলে ডাকাতদের দিয়ে দিল। কিন্তু রুখে দাঁড়াল শুধু চোদ্দ পনেরো বছর বয়সের একটি মেয়ে। সে বলল, " কিচ্ছু দেব না। এখনই চেন টানব"।
চেন আর তার টানা হয়নি, একটা ডাকাত তার গলাটা সাঁড়াশির মতো করে ধরে চলন্ত ট্রেনের দরজা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
তারপর থেকে প্রায়ই রেবা সোমকে দেখা যায়। কখনো ট্রেনের ভেতর, কখনো ট্রেনের জানলার বাইরে - ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটে।
ভয় পেয়ে অনেকে কত সময় যে চেন টেনে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে...... "
স্টেশনমাস্টার তাঁর কাহিনী শেষ করলেন।
......" তাহলে আমি যাকে দেখেছি, সে কে?" জিজ্ঞেস করলাম আমি।
...... " নিঃসন্দেহে সে রেবা সোম", বললেন স্টেশনমাস্টার, " আপনার ভাগ্য ভাল, যে আপনি প্রাণে বেঁচে গেছেন। এর মাসখানেক আগে একবার লাইন মেরামত হচ্ছিল, ট্রেন কিছুক্ষণের জন্য থেমেছিল। একটি কলেজের ছোকরা ট্রেন থেকে নেমে খোলা মাঠে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্যস, তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার। সকলে ট্রেন থেকে নেমে গিয়ে দেখে, ছোকরার নিস্পন্দ দেহ মাঠে পড়ে আছে। গলায় দশ আঙুলের দাগ। শ্বাসরোধ করে হত্যা।
লোকে বলেছিল, এ কোনও দুর্বৃত্তের কাজ। নির্জন মাঠে ছেলেটিকে একা পেয়ে তাকে হত্যা করেছে। কিন্তু আমি সে কথা বিশ্বাস করিনি। দুর্বৃত্তই যদি হবে, তাহলে ছেলেটির পকেটের টাকাপয়সা, হাতঘড়ি - কি করে ঠিক রইল? কেউ কি কাউকে বিনা উদ্দেশ্যে খুন করে?
একমাত্র রেবা সোম ছাড়া। তার অতৃপ্ত আত্মা প্রতিশোধ নেবার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমগ্র পুরুষজাতির প্রতি তার আক্রোশ, ঘৃণা। কারণ পুরুষ মানুষের দ্বারাই সে নিহত হয়েছে আর তার চরম বিপদের সময় কোনও পুরুষ তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। "
সেবার ঘাটশিলায় আর নামিনি। কোথাও নামতে সাহস হয়নি।
সোজা কলকাতায় ফিরে এসেছি।
অবসর সময়ে নিজের মনের সঙ্গে অনেক তর্ক করেছি। বার বার বোঝাতে চেষ্টা করেছি, যা কিছু ঘটেছে, সব মিথ্যে, মনের কল্পনা। ভূতের অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে ঠাণ্ডা একটা বাতাসের বলয় অনুভব করেছি। হাত থেকে এক গোছা কাঁচের প্লেট পড়ে ভেঙে গেলে যেমন শব্দ হয়, তেমনি শব্দ করে কে যেন হেসে উঠেছে।
রেবা সোম বুঝি বলতে চেয়েছে, " ওরে অবিশ্বাসী, আমরা আছি। অর্থহীন যুক্তি দিয়ে আমাদের উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়"।
ক্রমে যেন বিশ্বাসের বাঁধন শিথিল হয়ে আসছে। রেবা সোম আছে, তারা চিরদিন ছিল, থাকবেও - এই সত্যটাই স্বীকার করতে ইচ্ছে করছে।

No comments

Powered by Blogger.